ঢাকা,সোমবার, ৬ মে ২০২৪

লামায় ৩২টি ইটভাটায় অর্ধশতাধিক পাহাড় কাটা মাটিতে তৈরী হচ্ছে ইট

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার পূর্বসীমান্ত এলাকা বান্দরবানের লামায় চলতি শুষ্ক মৌসুমে অবৈধভাবে গড়ে উঠা ৩২টি ইটভাটা পরিবেশের বারটা বাজিয়ে পাহাড় কাটার অভিযোগ উঠেছে। সরকারি কোন অনুমোদন ছাড়াই ফাইতং ইউনিয়নের ২৫টি অবৈধ ইটভাটা সহ বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে উপজেলার ৩২টি ইটভাটা। বান্দরবান জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, অবৈধভাবে গড়ে উঠা এসব ইট ভাটার বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে মোবাইল কোট পরিচালনা করা হবে।
ইটভাটার প্রধান কাঁচামাল পাহাড়ের মাটি। ফলে উপজেলার ৩২টি ইটভাটার কাজে মাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে ইতিমধ্যে প্রায় ৩শতাধিক ছোট-বড় পাহাড় বিলীন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন, লামা পৌরসভা, ফাইতং, সরই, গজালিয়া ও ফাঁসিয়াখালী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দারা।
সরজমিনে লামার ফাইতং এলাকার ঘুরে দেখা যায়, এই ইউনিয়নের ২৫টি ইটভাটার মাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায় ২শতাধিক পাহাড় ইতিমধ্যে বিলীন করে ফেলেছে। নতুন করে আরো অর্ধশত পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়ি গ্রাম রাইম্যাখোলা, শিবাতলী পাড়া, মংব্রাচিং কারবারী পাড়া, ফাদু বাগান পাড়া, হেডম্যান পাড়া ও বাঙ্গালি পাড়ার অধিবাসীরা জানান, ইটভাটার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের বরাবর আবেদন করেও প্রতিকার পায়নি পরিবেশবাদী জনগন। বনজ সম্পদ ব্যবহারের সহজ লভ্যতা ও দূর্বল প্রশাসনিক তদারকির কারণে ফাইতং ইউনিয়ন অবৈধ ইটভাটা স্থাপনের নিরাপদ জোনে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রতিবছর বিনা বাধায় তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন ইটভাটা।
অবাধে পাহাড় কাটার কারণে দিনের পর দিন বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি এলাকা ফাইতংয়ের চেহারা। উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো সমতল হচ্ছে। বৃক্ষগুলো উজাড় হতে হতে মরুময় হয়ে গেছে পুরো এলাকা। ভরাট হয়ে গেছে ছোট ছোট পাহাড়ি ছড়া ও খাল। কোথাও ফসলি জমি নেই। ফলের বাগান নেই। নেই বৃক্ষবাগান। বিরানভূমিতে রূপ নিয়েছে এই জনপদ।
বিশেষ করে ইউনিয়নের শিবাতলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে ৩টি ইটভাটা। দুটি ভাটার মালিক বেলাল হোসেন ও অন্যটি মোহাম্মদ হুমায়ুনের। স্কুলটির শিক্ষকসহ ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকেরা জানান, বিদ্যালয়টি পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ইটভাটার মালিকরা স্কুলের চারপাশ ও খেলার মাঠের মাটি কেটে নিয়ে গেছে। শুধুমাত্র ভবনটি টিকে আছে কোনমতে। তারই মাঝে ভিতরে বসে ইট পোড়ানোর ধোঁয়ার চোখ পোড়ানোর সঙ্গে যুদ্ধ করছে চলছে কোমলমতি শিশুদের লেখাপড়া।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, এই বছর লামার ফাইতং এলাকায় ২৫টি, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে ৪টি, লামা পৌরসভায় ১টি, গজালিয়ায় ১টি ও সরই ১টি সহ মোট ৩২টি ব্রিকফিল্ড রয়েছে। কোনটিরই সরকারী অনুমোদন বা লাইসেন্স নেই বলে জানা গেছে। তবে বিনা বাধায় এতো ইটভাটা কিভাবে গড়ে উঠেছে তা একমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও বনবিভাগের কর্মকর্তারাই ভাল করে বলতে পাবরেন।
জানা গেছে, চরম পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ফাইতং-এ ২০১৫ সালে পাহাড়ধসে ১৩জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি কারো। ইটভাটাকে নিরুৎসাহিত করতে ভূমিকা নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন। কয়েক গজের মধ্যেই পুলিশ ফাঁড়ি, বন বিভাগের বিট অফিসারের কার্যালয়, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়। কিন্তু বন ও পাহাড় ধ্বংসের এমন হরিলুটের মাঝখানে বসে তারা রহস্যজনক নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি কবির আহমদ জানিয়েছেন, ইটভাটার কাঁচামাল মাটি বর্ষাকালে সংগ্রহ করা হয়ে গেছে এখন শুধু ইট পোড়ানোর কাজ। নভেম্বর মাসের শেষের দিক থেকে ইটভাটায় আগুন দেয়া হয় আর চলে মে-জুন মাস পর্যন্ত। তবে আমাদের কোন সরকারী অনুমোদন নেই তবে হাইকোর্টের একটি রিট মূলে ব্রিকফিল্ড গুলো চলছে। এছাড়াও উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রশাসনের লোকজনকে ঘাটে ঘাটে নগদ নারায়ন দিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছি।
ফাইতং ইউপি চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, স্থানীয় ভূমি মালিকদের কাছ থেকে জমি লিজ বা ক্রয় করে ফাইতং ইউনিয়নে ইট ভাটা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে ফাইতং ইউনিয়নের ইটভাটাগুলোকে ব্যবসায়িক সনদ (ট্রেড লাইসেন্স) দেওয়া হলেও পরিবেশ বিনষ্টের আশঙ্কা এড়াতে ২০১৬ থেকে অদ্যাবধি কোন ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়নি।
লামা উপজেলার দায়িত্বরত পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক জানিয়েছেন, বান্দরবান জেলায় সরকারের অনুমোদন প্রাপ্ত কোন ইট ভাটা নাই। পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ইট ভাটা স্থাপনের জন্য কোন ছাড়পত্র প্রদান করা হয় নাই।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও লামা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূর-এ-জান্নাত রুমি বলেন, ব্রিকফিল্ড সংশ্লিষ্ট সকলকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন যথাযথ পরিপালনের নির্দেশ প্রদান করেন। অন্যথায় আরো কঠোর আইনের প্রয়োগ করা হবে তিনি জানান।

পাঠকের মতামত: